এমন কলঙ্কজনক নির্বাচন আগে আর হয়নি

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক কলঙ্কিত নির্বাচন। এমন কলঙ্কজনক নির্বাচন দেশের ইতিহাসে আর হয়নি।

নজিরবিহীন ভুয়া ভোটের এ নির্বাচনের আগের রাতে প্রশাসনের সহায়তায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। বিরোধীপক্ষের প্রার্থী ও এজেন্টদের ‘হুমকি’, কেন্দ্র থেকে ‘মারধর করে’ এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়।

রাজধানীর সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে আয়োজিত গণশুনানিতে শুক্রবার ধানের শীষের প্রার্থীরা এসব অভিযোগ করেন। আগে থেকে পরিকল্পনা করেই এমন ভোট ডাকাতির নির্বাচন করা হয়েছে বলেও দাবি তাদের।

প্রার্থীরা ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে বলেন, ভোটের প্রচারে নেমে শীর্ষ নেতাদের কথার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল পাওয়া যায়নি। 

বরং ২৪ ডিসেম্বরের পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা, হয়রানি আরও বেড়ে যায়। ভোট প্রত্যাখ্যান করার পর বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি না দেয়ার সমালোচনা করে তারা বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি না হওয়ার পেছনে কারা দায়ী তা খুঁজে বের করতে হবে। 

খালেদা জিয়া মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি দিতে ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন ও মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রতি দাবি জানান তারা।

এ গণশুনানির আয়োজন করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সকাল ১০টা থেকে দুপুরে এক ঘণ্টার বিরতি দিয়ে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত চলা এ গণশুনানিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ২৯৮ প্রার্থীর মধ্যে অন্তত ২০০ প্রার্থী উপস্থিত ছিলেন।

এর মধ্যে ৪২ জন বক্তব্য দেন। এ সময় প্রার্থীরা ভোটের নানা ‘অনিয়ম’, ‘কারচুপি’সহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের প্যানেলের সামনে। 

মূল মঞ্চে থাকা প্যানেলের অন্যরা হলেন- অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক নুরুল আমিন ব্যাপারী, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সাবেক বিচারক সা ক ম আনিসুর রহমান খান ও অ্যাডভোকেট মহসিন রশিদ। 

গণশুনানি শেষে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’র শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, এ নির্বাচনকে নির্বাচন বলা যাবে না। এটা তথাকথিত নির্বাচন। এটাকে বলা যেতে পারে সরকার একটা প্রহসন করেছে।

দেশের নাগরিকদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সংবিধান অমান্য করে গণতন্ত্রের মূলনীতির প্রতি অবমাননা করা হয়েছে। 

তিনি বলেন, অনেকেই বলে যে, আওয়ামী লীগের নামে যেটা করা হচ্ছে এটাকে আওয়ামী লীগ বলা চলে না। আমরাও সেটা মনে করি। আমরা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করেছি, এই আওয়ামী লীগ নয়।

কামাল হোসেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে বলেন, অনেকে এখানে খালেদা জিয়ার মুক্তির কথাটি বলেছেন। এটা ন্যায্য দাবি। 

আমরা অন্য প্ল্যাটফর্ম থেকে এ মুক্তি চেয়েছি। আজকে সবাই এখান থেকে জোরালোভাবে তার মুক্তি চেয়েছেন। আমি অবিলম্বে তার মুক্তির দাবি করছি।

৩০ ডিসেম্বর প্রহসনের নির্বাচন হয়েছে দাবি করে ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় সরকার যা ইচ্ছা তাই করছে। এ জন্য সরকারকে জবাবদিহিও করতে হয় না। ৩০ ডিসেম্বর কোনো নির্বাচন হয়নি, হয়েছে ভোট ডাকাতি।

গণশুনানিতে মির্জা ফখরুল ও ড. আবদুল মঈন খান ছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির কোনো সদস্য উপস্থিত ছিলেন না। ২০ দলীয় জোটে থাকা জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। 

বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও তাদের কাউকে দেখা যায়নি শুনানিতে। এছাড়া ২০ দলীয় জোটের প্রধান সমন্বয়ক কর্নেল (অব.) অলি আহমেদসহ শরিক নেতাদের অধিকাংশই ছিলেন অনুপস্থিত।

টাঙ্গাইল-৮ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকী গণশুনানিতে বলেন, এবার বাংলাদেশে ভোট হয়েছে ৩০ ডিসেম্বর ভোটের আগের রাতে।

যশোর-৩ আসনের বিএনপির প্রার্থী অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, ২০ তারিখের পর ২৯ তারিখ পর্যন্ত আমার এলাকায় ১৩টি মামলায় নাম উল্লেখপূর্বক ১ হাজার নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে, সহস্রাধিক অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। আমার প্রধান নির্বাচনী এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

 ২৫ তারিখ পর আমার পাশে কার্যত কোনো নেতা-কর্মী থাকতে পারেনি। এমন অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে আমি ভোটযুদ্ধে মাঠে ছিলাম।

হবিগঞ্জ-১ আসনের রেজা কিবরিয়া বলেন, নির্বাচনের দেড় মাস আগে থেকে নেতা-কর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারেনি, হাওরে লুকিয়ে থেকেছেন। দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন এক নেতাকে বাড়িতে পায়নি, তার ১৬ বছরের ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে।

 বলেছে, ‘তোর বাপ আসলে তোকে ছাড়ব’। এরকম পরিস্থিতিতে ৩০ ডিসেম্বর কোনো ভোট হয়নি, চুরি হয়েছে, হয়েছে ডাকাতি। 

গাজীপুর-৩ আসনের প্রার্থী ইকবাল সিদ্দিকী বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকায় ১৬৯টা কেন্দ্রের মধ্যে একটি কেন্দ্রেও স্বচ্ছ ভোট হয়নি।

নাটোর-২ আসনের প্রার্থী সাবিনা ইয়াসমিন ছবি বলেন, আমার ওপরও আক্রমণ করে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা। আমি গুরুতর আহত হই। এরপরও হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে আমি প্রচার চালিয়ে যাই। 

৩০ ডিসেম্বর ভোট শুরুর পরপরই খবর পাই কোনো কেন্দ্রেই আমার পোলিং এজেন্ট ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনে যেতে তৈরি হচ্ছিলাম, দেখি আমার বাসার দরজা তালা মেরে রাখা হয়েছে। রিটার্নিং অফিসার, এসপি, ওসিকে বলেও প্রতিকার পাইনি। শেষে ১২টায় নির্বাচন বর্জন করি।

কেন্দ্রীয় নেতাদের সমালোচনা করে কুমিল্লা-১০ আসনের প্রার্থী মনিরুল হক চৌধুরী বলেন, আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, আমাদের প্রতি জনসমর্থন ছিল শতভাগ। 

কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতারা কিছু করতে পারেনি কেন- তা জানা দরকার। তার জন্য আরেকটি গণশুনানি বা সমাবেশ দরকার। আমি মহাসচিব মির্জা ফখরুল, ড. কামাল হোসেন, মান্না, আ স ম আবদুর রব, মোস্তফা মোহসীন মন্টুর কাছে জানতে চাই- কেন পারলাম না কিছু করতে? 

এ বিষয়ে একটি জবাবদিহি দরকার বলে মনে করি। তিনি বলেন, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবরা যদি বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সমাবেশ দেন।

 যারা প্রোগ্রাম দেবেন তারা যদি বলেন প্রোগ্রাম দেন, তাহলে প্রোগ্রামটা দেবেন কে? বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া কিছুই সম্ভব হবে না। আর কিছু না করে খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যবস্থা করুন। কর্মসূচি দেন।

নোয়াখালী-২ আসনের জয়নুল আবদীন ফারুক বলেন, আমি ড. কামালকে বিশ্বাস করি, আমি আমার দলকে বিশ্বাস করি। কিন্তু আমার মা, আমার নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে কেন কোনো কিছু করতে পারছি না?

 নির্বাচনে এত বড় ডাকাতি হল, সব জানার পরও কেন আমরা কিছু করলাম না? ৩১ ডিসেম্বর কেন খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সমাবেশ করলাম না?

 তিনি বলেন, ২৭ ডিসেম্বর ব্যারিস্টার মওদুদ ও বরকতউল্লাহ বুলুর ফোনালাপের পর নির্বাচন বয়কট করা উচিত ছিল। আমি ধন্যবাদ জানাই মওদুদকে। সেদিন আমরা নোয়াখালীর ৬ জন নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

জয়নুল আবদিন বিএনপি মহাসচিবকে উদ্দেশ করে বলেন, দেখি না দেখি না করে সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। চোর সব কিছু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। আপনার দেখি না দেখি না শেষ হয় না। আর সহ্য হয় না মাননীয় মহাসচিব। আমার মাকে জেলে রেখে আর কিছু সহ্য করতে পারছি না।

লালমনিরহাট-৩ আসনের আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, তিনশ’ আসনে ভোট ডাকাতির চিত্র একই রকম। নির্বাচন ৩০ তারিখ হয়নি, এর আগের রাতেই হয়েছে। আমার এলাকায় ভোটের আগের রাত ১টা থেকে ব্যালট নিয়ে সিল মেরেছে। 

ঢাকা-৬ আসনে গণফোরামের প্রার্থী সুব্রত চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা যেমন নির্মমতা করেছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের রাতে ২৯ ডিসেম্বর এ সরকার ভোট ডাকাতির ঘটনাও ইতিহাসে তেমন কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

লক্ষীপুর-৪ আসনে আ স ম আবদুর রবের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও তার স্ত্রী তানিয়া রব বলেন, আমরা যারা ভোট করেছি তাদের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। 

৩০ ডিসেম্বর নাগরিকরা ভোট দিতে পারেননি। তারা অপমানিত হয়েছেন। প্রতিদিন আমার মনে হয়েছে, এ রাষ্ট্রের মালিক আমরা নই। আমি বলব, সরকার জনগণকে যে অপমান করেছে তার করণীয় নেতারা ঠিক করুন।

সিরাজগঞ্জে পুলিশের গুলিতে দুই চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়া মেরি বেগম ঘটনা তুলে ধরলে গণশুনানিতে উপস্থিত প্রার্থী-সমর্থকরা আবেগময় হয়ে পড়েন। 

কামাল হোসেনসহ অন্যদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে পড়ে। মেরি বেগম বলেন, ১৪ ডিসেম্বর পুলিশ যে আমাকে গুলি করবে, এটা আমার কল্পনার বাইরে। সেই দৃশ্য আমাকে ধুঁকে ধুঁকে কাঁদাচ্ছে, এই দৃশ্য আমি ভুলতে পারি না।

 আমার একটা কথা দেশবাসীর কাছে, চোখ হারিয়েছি আমার দুঃখ নাই। কিন্তু সবচেয়ে বড় দুঃখ, আমি ৩০ তারিখে ভোট দিতে পারি নাই। শুনেছি ২৯ তারিখ রাত ১২টায় ভোট শেষ হয়ে গেছে। আমার দাবি, আমি ভোট দিতে চাই। নইলে আমার দুই চোখ ফেরত দেন।

গণশুনানি শুরুর আগে পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে শোকপ্রস্তাব উপস্থাপন করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ সময় সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। পরে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়।

গণশুনানি পরিচালনা করেন আবদুস সালাম, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জগলুল হায়দার আফ্রিক ও শহীদ উদ্দিন মাহমুদ। প্রার্থীদের মধ্যে গণশুনানিতে আরও অংশ নেন- নিতাই রায় চৌধুরী (মাগুরা-২), মিজানুর রহমান মিনু (রাজশাহী-২), হাবিবুর রহমান হাবিব (পাবনা-৪), ফজলুর রহমান (কিশোরগঞ্জ-৪), খায়রুল কবির খোকন (নরসিংদী-১), শহিদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী (লক্ষীপুর-৩),

 রুমানা মাহমুদ (সিরাজগঞ্জ-২), আনিসুর রহমান তালুকদার (মাদারীপুর-৩), মাহমুদুল হক রুবেল (শেরপুর-৩), আবুল হোসেন খান (বরিশাল-৬), শামা ওবায়েদ (ফরিদপুর-২), সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল (নরসিংদী-৪), নুরুল ইসলাম আজাদ (নারায়ণগঞ্জ-২), হাবিবুল ইসলাম হাবিব (সাতক্ষীরা-১), আখতারুজ্জামান মিয়া (দিনাজপুর-৪), সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক (ঢাকা-১৪), 

শাহজাহান চৌধুরী (কক্সবাজার-৪), রুহুল আমিন দুলাল (পিরোজপুর-৩), শাহ মো. ওয়ারেছ আলী মামুন (জামালপুর-৫), সাইফুল ইসলাম ফিরোজ (ঝিনাইদহ-৪), সাইফুল ইসলাম (রংপুর-৬), জেএসডির সাইফুল ইসলাম (কিশোরগঞ্জ-৩), গণফোরামের মোস্তফা মহসিন মন্টু (ঢাকা-৭), 

নাগরিক ঐক্যের এসএম আকরাম (নারায়ণগঞ্জ-৫), নুরুর রহমান জাহাঙ্গীর (বরিশাল-৪), লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান (পিরোজপুর-২), আমসা আমিন (কুঁড়িগ্রাম-২), আহসান হাবিব লিংকন (কুষ্টিয়া-২), ডা. শাহাদাত হোসেন (চট্টগ্রাম-৯) ও নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেলেও পরে আদালত কর্তৃক বাদ পড়া খোন্দকার আবু আশফাক (ঢাকা-১)।

এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে গত ১১ জানুয়ারি বাম গণতান্ত্রিক জোট গণশুনানি করেছিল।
এমন কলঙ্কজনক নির্বাচন আগে আর হয়নি এমন কলঙ্কজনক নির্বাচন আগে আর হয়নি Reviewed by বার্তা কক্ষ on February 23, 2019 Rating: 5

Post Comments

Powered by Blogger.